ঢাকা,সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমঝোতার ভিত্তিতেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে: সু চি

নিউজ ডেস্ক ::

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা নিতে সম্মত মিয়ানমার; এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি। গত ৭ জুন নেপিদোতে জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আশাহি শিমবুনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আইন বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিদেশি পরামর্শকদের সহায়তা নিতে আপত্তি নেই মিয়ানমারের। অতীতের ধারাবাহিকতায় ওই সাক্ষাৎকারেও সু চি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমঝোতার ভিত্তিতেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উৎসাহিত করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।

গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো হওয়ার এক পর্যায়ে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে সেই চুক্তির পর বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও ধোঁয়াশা কাটছে না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৮ হাজার রোহিঙ্গার নাম প্রস্তাব করা হলেও মাত্র ৬০০ জনকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার। এমন অবস্থায় অতীতের ধারাবাহিকতায় আবারও প্রত্যাবাসন চুক্তি মেনে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন সুচি। প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সংবাদমাধ্যম আশাহি শিমবুনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সু চি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে যে সমঝোতা হয়েছে আমরা তার ভিত্তিতেই এগোচ্ছি।’
এর আগেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সু চি। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে।
গত বছর আগস্টে নিরাপত্তা চেকপোস্টে সন্ত্রাসী হামলার পর রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ঘটনাকে জাতিগত নিধন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ আখ্যা দেয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ। তবে মিয়ানমার শুরু থেকে সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত অভিযোগকে বহুদিন আমলেই নেয়নি মিয়ানমার। সম্প্রতি রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিচার করা যায় কিনা, তা নিয়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণ জানতে চেয়েছেন ওই আদালতেরই একজন প্রসিকিউটর। নিধনযজ্ঞের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সম্প্রতি ৪০০ রোহিঙ্গার পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দারস্থ হয়েছেন মানবাধিকার আইনজীবীরা। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশও মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে সংকট নিরসনের। এমন বাস্তবতায়, প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে নেপিদো।

৬ লাখ ৯২ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করার পর প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতির সমান্তরালে তাদের পুড়িয়ে দেওয়া আবাস বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। এক পর্যায়ে সেনা অভিযান বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলেও অব্যাহত থাকে জাতিগত নিধন। এরপর সামরিকায়নকে জোরালো করতে অবশিষ্ট ঘরবাড়িও নিশ্চিহ্ন করা হয়। ঘোষণা দেওয়া হয় জমি অধিগ্রহণের। শুরু হয় অবকাঠামোসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সেখানে ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ গড়ে তোলা হচ্ছে। রোহিঙ্গাশূন্য বাফারজোন প্রতিষ্ঠা করতে সেখানে বৌদ্ধদের অর্থায়ন ও সেনা মদতে গড়ে উঠছে সংস্থা। এমন বাস্তবতায় গত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত- আইসিসি তৎপর হয় এই ইস্যুতে। রোহিঙ্গা বিতাড়নকে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধ বিবেচনা করে মিয়ানমারের বিচার শুরু করা যায় কিনা; গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (৯ এপ্রিল) সে ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে আইসিসি-তে আবেদন করেন এর কৌঁসুলি ফাতাও বেনসুউদা। গত ৩০ মে তারিখে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধকে বিচারের আওতায় নিতে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদন জানায় রোহিঙ্গাদের পক্ষের আইনজীবীরা।
আইসিসির তৎপরতা জোরালো হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমারের পূর্ববর্তী অবস্থান বদলাতে শুরু করে একটু একটু করে। মে মাসে রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা আসে। ২ জুন প্রথমবারের মতো তারা সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সিঙ্গাপুরে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সম্মেলন শাংরি-লা সংলাপে মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং তুন প্রতিশ্রুতি দেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ৭ লাখ রোহিঙ্গার সবাই যদি স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায় তাহলে সবাইকে ফিরিয়ে নিতে রাজি মিয়ানমার। সু চি তার সাক্ষাৎকারে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মনে করি তদন্ত কমিশনটি আমাদের পরামর্শও দিতে পারবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়ক হবে।’ রাখাইনের বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা অবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সেখানে শান্তি ‘রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়।’ তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন পরবর্তী নিরাপত্তার প্রশ্নে সু চি বলেছেন, ‘আমাদেরকে সব নাগরিকদেরই নিরাপত্তা দিতে পারতে হবে, বিশেষ করে স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে। সেজন্য আমরা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি।’
জাতিগত সমস্যাগুলোর সমাধানে তার সরকারের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে প্রচণ্ড সমালোচনা কুড়িয়েছে সে বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে অং সান সু চি বলেছেন, ‘একটা ঘটনাকে এক এক দিক থেকে দেখা যায়। তারা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। আমাদের অনুধাবন তাদের চেয়ে ভিন্ন।’

পাঠকের মতামত: